হাড়গিলা পাখি পরিচিতি - হাড়গিলা পাখির বৈশিষ্ট, সামাজিক ও প্রজননকালীন আচরন এবং সংরক্ষন অবস্থা



হাড়গিলা একটি বৃহত্তম প্রজাতির সারস জাতীয় পাখি। একে বড় মদনটাক নামেও ডাকা হয়।হাড়গিলা পাখির ইংরেজী নাম গ্রেটার আ্যাডজুট্যান্ট (Greater Adjutant) এবং বৈজ্ঞানিক নাম Leptoptilos dubius । অনেকে এদের ভারতীয় আ্যাডজুট্যান্টও বলে ডাকে। আজকের পোস্টে হাড়গিলা পাখির আবাসস্থল, শরিরীক বৈশিষ্ট, প্রজননকালীন আচরন, সামাজিক আচরন এবং সংরক্ষন অবস্থা নিয়ে আলোচনা করবো।

আবাসস্থল 

হাড়গিলা দক্ষিন এবং দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার একটি স্থানীয় পাখি। এরা জলচর পাখি। গ্রেটার অ্যাডজুট্যান্ট সাধারণত জলাভূমি, প্লাবনভূমি, কৃষিক্ষেত এবং জলাভূমিতে চরে বেড়ায়। অনেক সময় ময়লা আবর্জনার ডাস্টবিনের আশে পাশেও এদের দেখা যায়। ডিম পাড়ার জন্য এরা বড় গাছে বাসা বাঁধে। বিশেষ করে শিমুল, কদম গাছের মগডালে বাসা বাঁধে।

শারীরিক বৈশিষ্ট্য

হাড়গিলার শারীরিক চেহারা আকর্ষণীয় এবং সহজে চেনা যায়এর বড় আকারখালি মাথা এবং ঘাড় এবং স্বতন্ত্র রঙ। হাড়গিলা বড় প্রজাতির পাখি। পুরুষদের উচ্চতা চার ফুট পর্যন্ত হয় এবং ওজন হয় প্রায় চার কেজির মতো। স্ত্রী হাড়গিলা আকারে পুরুষের তুলনায় কিছুটা ছোট।

হাড়গিলার ঠোট আকারে বড় এবং হলুল বর্ণের হয়। এদের শরীরের পালকের রং ধূসর বাদামী এবং একটি খালিকুঁচকানো মাথা এবং ঘাড় এদের মাথা এবং ঘাড় প্রায়শই লাল বা গোলাপী বর্ণের হয়।

এদের ডানার বিস্তৃতি প্রায় আট ফুট যা পাখির প্রজাতির মধ্যে সবছেয়ে বড়গুলোর একটি।এদের দেহে লম্বা এবং ছোট পালকের মিশ্রণ রয়েছেডানা এবং লেজে লম্বা পালক রয়েছে।

এদের পা কর্দমাক্ত মাটিতে হাঁটার জন্য বিশেষ ভাবে অভিযোজিত। পা মজবুত লম্বা এবং শক্তিশালী ট্যানেল রয়েছে। যার ফলে এরা সহজেই কর্দমাক্ত মাটিতে হেঁটে মাছ মিকার করতে পারে।

প্রজননকালীন আচরন

হাড়গিলার প্রজনন আচরন অন্যান্য স্ট্রক পাখির ছেয়ে কিছুটা ভিন্ন। প্রজননকালীন সময়ে অনেকগুলো স্ত্রী হাড়গিলা একটি গাছে বাসা বাঁধে ডিম পাড়ার জন্য। 

প্রজনন ঋতু

বৃহত্তর অ্যাডজুট্যান্ট প্রজনন ঋতু শুষ্ক মৌসুমে শুরু হয়। যা সাধারণত অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রজননের সর্বোচ্চ সময়।

বাসা তৈরী

হাড়ড়িলা পাখি তাদের বাসা তৈরি করে লম্বা গাছে, সাধারণত পানির ধারে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা গাছে। বাসা  তৈরীর প্রধান ও মূল উপকরন লাঠি এবং পাতা। সাধারনত লাঠি এবং পাতা দিয়ে সারিবদ্ধ বড়, ভারী বাসা তৈরি করে। একবার বাসা তৈরী করলে তা প্রায়ই বছরের পর বছর মেরামত করে পুনরায় ব্যবহার করা হয়।

সঙ্গম 

প্রজনন ঋতুতে, পুরুষ হাড়গিলা পাখি স্ত্রী হাড়গিলাকে আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন কৌশল প্রদর্শন করে যা কোর্টশিপ নামেও পরিচিত। হাড়গিলার কোর্টশিপ আচরণের মধ্যে রয়েছে, পুরুষরা তাদের ডানা ধরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং ঘাড় প্রসারিত করে জোরে ডাক দেয়। স্ত্রী হাড়গিলার বাসা বাধা সম্পূর্ণ হলে সে আশেপাশের পুরুষ হাড়গিলার ডাকে সাড়া দিয়ে কাছাকাছি আসে। একবার একটি জুটি তৈরি হয়ে গেলে, তারা পারস্পরিক স্নেহ এবং প্রীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মিলনে আবদ্ধ হয়।

ডিম পাড়া 

স্ত্রী হাড়গিলা পাখি প্রতি মৌসুমে এক থেকে তিনটি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার পর পুরুষ ও স্ত্রী হাড়গিলা উভয়েই পালা করে ডিমে তা দেয়। প্রায় ২৮ থেকে ৩০ দিন তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।

ছানা-পালন:

ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পর স্ত্রী এবং পুরুষ উভয়ই বাচ্চাদের যত্ন নেয়। উভয়েই বাচ্চাদের খাওয়ার দায়িত্ব সমানভাবে পালন করে। বাচ্চাগুলো দ্রুত বড় হতে থাকে। প্রায় সত্তর দিন পর উড়তে সক্ষম হয়। যদিও বাচ্চাগুলো প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস বাবা মায়ের তত্ত্বাবধায়ানে থাকে এবং স্বাধীন ভাবে চলাচল করার উপযোগী হওয়ার পর বাসা ছেড়ে চলে যায়।  

সামাজিক আচরন

হাড়গিলা সামাজিক পাখি। এরা দলবদ্ধভাবে থাকে। একটি দলে ১৫০টি পর্যন্ত হাড়গিলা থাকতে পারে।  এমনকি একই গাছে অনেকগুলো পাখি বাসা বাঁধে। কখনো কখনো একই বাসা কয়েকটি দম্পতি ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে। এমনকি একই গাছে বাসা বাঁধা অন্য হাড়গিলার বাচ্চাকেও খাবার খাওয়া ও যত্ন নিতে দেখা যায়। আবার অন্যান্য প্রজাতির মাছ শিকারী পাখিদের সাথে এরা খাবার ভাগ করে নিতেও দেখা যায়।

যদিও এরা সামাজিক প্রানী তবে প্রজনন মৌমুমে এরা অনেকটা হিংস্র হয়ে উঠে। বিশেষ করে পুরুষ হাড়গিলা স্ত্রী সঙ্গীর জন্য অন্য পুরুষ হাড়গিলার সাথে আক্রমনাত্বক এবং হিংস্র হয়ে উঠে। এমনকি মারামারিও করতে পারে।

এরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে বিভিন্ন ধরনের শব্দের ব্যবহার করে। আবার বাচ্চারা তাদের কণ্ঠস্বার দ্বারা বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।

সংরক্ষন অবস্থা

হাড়গিলা পাখি প্রজাতিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (IUCN) লাল তালিকায় বিপন্ন হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

হাড়গিলা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক আগে। এদের বিলুপ্তির পেছনে অনেকগুলো কারনের মধ্যে একটি হচ্ছে এই পাখিগুলো নিয়ে কুসংস্কার। এই পাখিগুলোকে নিয়ে সমাজে প্রচলিত কিছু কুসংস্কারের নিম্নরূপ-

কোন কোন অঞ্চলের মানুষ মানুষ মনে করতো হাড়গিলা সৌভাগ্য বয়ে আনে। তাই যাত্রাপথে হাড়গিলার দেখা পেলে কিংবা মাথার উপর দিয়ে হাড়গিলা উড়ে গেল দিনটি শুভ হতো এমন বিশ্বাস মানুষ মনে ধারন করতো।

বিপরতীতে কিছু কিছু সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করতো হাড়গিলা পাখি যে বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে যায় সেই বাড়ির কেউ শীঘ্রই মারা যাবে। হাড়গিলা পাখির উপস্থিতি ঐ এলাকার জন্য অশুভ বার্তা নিয়ে আসে।

কিছু অঞ্চলে, হাড়গিলাকে মৃত্যুর প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এর উপস্থিতি একটি আসন্ন মৃত্যুর পূর্বাভাস দেয় বলে বিশ্বাস করা হয়। কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে, পাখিটিকে এমনকি "শব পাখি" বলা হয় কারণ এটি মৃত প্রাণীর মাংস এমনকি হাঁড়ও খেয়ে ফেলে।  

হাড়গিলা পাখির সংখ্যা হ্রাসের কয়েকটি উল্লেখ্যযোগ্য কারন হচ্ছে-

০১. বাসস্থানের ক্ষতি, বন উজাড়, নগরায়ণ এবং জলাভূমিকে কৃষিতে রূপান্তরের মতো মানবিক কার্যকলাপের কারণে বৃহত্তর অ্যাডজুট্যান্টের আবাসস্থল দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। 

০২. বৃহত্তর অ্যাডজুট্যান্ট ঐতিহাসিকভাবে এর মাংস, পালক এবং শরীরের অন্যান্য অংশের জন্য শিকার করা হয়েছে, যেগুলির ঔষধি গুণ রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।

০৩. গ্রেটার অ্যাডজুট্যান্টের আবাসস্থল প্রায়ই কীটনাশক এবং ভারী ধাতুগুলির মতো দূষিত পদার্থ দ্বারা দূষিত হয়, যা পাখি এবং তাদের শিকারের উপর মারাত্মক স্বাস্থ্য প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে পাখিন ডিম পাড়ার হার বাচ্চা ফুটার হার কমিয়ে দেয়।  

০৪. জলবায়ু পরিবর্তন বৃহত্তর অ্যাডজুট্যান্টের বাসস্থানকে পরিবর্তন করছে, এটি খরা এবং বন্যার মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। এটি পাখির জন্য খাদ্যের প্রাপ্যতা এবং বাসস্থানের উপযুক্ততা হ্রাস করে। 

 তবে আশার কথা হচ্ছে ভারতের আসামের প্রাণীবিদ ডঃ পূর্ণিমা দেবী বর্মণের একক প্রচেষ্টায় এই পাখিটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। ২০০৮ সালের দিকে যেখানে ২০০ এর কম হাড়গিলা পাখি অবশিষ্ট ছিলো আসামে বর্তমানে সেই সংখ্যা প্রায় ১২০০ এর কাছাকাছি। হাড়গিলা পাখি সংরক্ষনের জন্য প্রাণীবিদ ডঃ পূর্ণিমা দেবী বর্মণ আসামের মহিলাদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছেন যার সদস্য সংখ্যা প্রায় দশ হাজার গ্রামীন মহিলা। 


উপসংহার

প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিটি প্রানীর বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব রয়েছে। কোন একটিন প্রানীর বিলুপ্তি মানে সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের উপর তার বিরূপ প্রভাব পড়া। হাড়গিলা পাখি সর্বভূক প্রানী হওয়ায় এরা আমাদের ময়লা আবর্জনা খেয়ে যেমন পরিবেশ সুন্দর রাখে তেমনি কৃষি ক্ষেতের ইঁদুর পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের উপকার করে। কোন প্রানীরই অলৌকিক ক্ষমতা নেই। তাই কুসংস্কারে বিশ্বাস করে এই প্রানীটিকে হত্যা করা উচিত নয়। বরং একে রক্ষা করার জন্য ডঃ পূর্ণিমা দেবী বর্মণের মতো আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url