বিন্টুরং বা বিয়ার ক্যাট সম্পর্কে জানা অজানা সকল তথ্য


বিন্টুরং বা বিয়ার ক্যাট

বিন্টুরং বা বিয়ার ক্যাট

বিনটুরং বা বিয়ার ক্যাট একটি মাঝারি আকৃতির স্তন্যপায়ী প্রানী। ভিভারিডি পরিবারভূক্ত এই প্রানীটির বৈজ্ঞানিক নাম- Arctictis binturong  ইংরেজিতে এদের Binturong or Bearcat বলা হয়। 

আবাস্থলঃ 

বিনটুরং গ্রীষ্মমন্ডলীয় আদ্র ও ঘন বনের গাছের মগডালে বাস করে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আওতায়  বাংলাদেশ, ভুটান, ক্যাম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, লাওস,মালয়েশিয়া, নেপাল, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের গ্রীষ্মমন্ডলীয় আর্দ্র বনে এদের দেখা যায়। যদিও বাংলাদেশ সহ কয়েকটি দেশে এদের উপস্থিতি একেবারেই কমে গেছে। ২০১৭ সালের ০৩ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের তাহেরপুর গ্রামে সর্বশেষ একটি বিনটুরং ধরা পড়েছে। 

এরা ভালুক কিংবা বিড়াল নয়ঃ

এদের আদি নামের উৎস বিনটুরং কিভাবে হয়েছে তার তথ্য অজানা। বিনটুরং এর চেহারা বিড়ালের মতো, শরীরের গঠন ছোট আকারের ভালুকের মতো এবং লেজ বানরের মতো হওয়ায় এদের বিয়ার ক্যাট নামেও ডাকা হয়।  মজার ব্যাপার হচ্ছে বিয়ার ক্যাট নাম হলেও বাস্তবে এদের সাথে বিড়াল কিংবা ভালুকের কোন সম্পর্ক নেই। এরা Viverridae পরিবারের ছোট স্তন্যপায়ী প্রানী এবং সিভেট (গন্ধগোকূল) এবং জিনেটদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। 

বৈশিষ্ট্যাবলীঃ

বিনটুরং লম্বায় দুই থেকে তিন ফুট হয়ে থাকে এবং ওজন এগার থেকে পঁয়ত্রিশ কিলোগ্রামের মতো হয়। তবে স্ত্রী বিনটুরং গুলো পুরুষদের তুলনায় আকারে বড় হয়। এদের সমগ্র দেহ ঘন কালো কিংবা হালকা বাদামী রং এর পশম দ্বারা আবৃত থাকে। মুখে বিড়ালের মতো সাদা দাঁড়ি থাকে। বিরটুরং এর লেজ তাদের শরীরের সমান যা, পুরু এবং গোড়ার দিকে পেশীবহুল। এদের লেজ এদের শরীর ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে বিশেষ করে গাছে উঠার সময় কিংবা দৌড়ানোর সময়। অনেক সময় এরা লেজের ডগা দিয়ে গাছের ঢাল ধরে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। গাছের ঢালে ঘুমানোর সময় এদের লেজ নোঙ্গরের মতো কাজ করে। এরা ভালুক ও মানুষের মতো সমতল পায়ে হাটতে পারে। যখন মাটিতে চলাচল করে তখন এরা ভালুকের মতোই হাটে। 

বাসস্থানঃ

বিনটুরং গাছের মগডালে থাকে। খুব কম সময়ই এরা মাটিতে নামে। গাছে ফল সহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ এবং পাখির ডিম সহজলভ্য বলে এদের খুব কম সময়ই মাটিতে নামতে হয়। এদের লম্বা নখর দ্বারা এরা সহজের গাছ আঁকড়ে ধরে গাছে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে। লেজকে নিছে দেকে ঝুলিয়ে কিংবা গাছের ডালের সাথে পেঁছিয়ে এরা গাছে ঘুমিয়ে থাকে। যদিও এরা বেশীরভাগ সময় গাছেই কাটায় তারপরেও এরা বানরের মতো লাফ দিয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যেতে পারে না। এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাওয়ার জন্য  তাদের মাটিতে নামতে হয়।  

খাদ্যভাসঃ

বিনটুরং মাংসাশী প্রানী। ছোট আকারে স্তন্যপায়ী (যেমন- ইঁদুর, ছুঁচো) ছোট আকারের পাখি, পাখির ডিম, ছোট আকারের সরিসৃপ এবং সরিসৃপের ডিম, আর্থোপড প্রানী এবং পোকামাকড় খেয়ে থাকে। যদিও এরা মাংসাশী কিন্তু এরা মাংসের ছেয়ে ফল খায় বেশী। মাংসের ছেয়ে ফল এদের প্রিয়। এরা প্রায় সকল ধরনের ফল খায় তবে কলা, গাজর, টমেটো এদের বেশী পছন্দ। এছাড়াও এরা গাছের বীজ, অঙ্কুর, ফুল ও পাতাও খেয়ে থাকে। 

বন্দীদশায় চিড়িয়াখানায় কিংবা পোষা প্রানী হিসেবে বাসায় থাকলে এরা কুকুরের খাবারও খায়। সেই হিসেবে এদের সর্বভূক প্রানীও বলা যায়। 

যোগাযোগঃ

বিনটুরাং শান্ত এবং লাজুক প্রানী। তবে এরা অনেক বেশী চেঁচামেচি করতে পারে। এরা যখন খুব আনন্দিত হয় তখন মৃদুস্বরে গো গো শব্দ করে সেই আনন্দ প্রকাশ করে। আবার যখন কোন কারনে বিরক্ত হয় তখন বিড়ালের মতো শব্দ করে। এছাড়া ভয় পেলে এরা উচ্চস্বরে চেঁচামেচি করে সমগ্র বনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। 

বিনটুরং এর শরীর থেকে বাটার পপকর্ণের গন্ধ নিঃসৃত হয়। বিনটুরাং এর লম্বা লেজের নিছে ঘ্রান গ্রন্থি আছে যা হতে বাটার পপকর্নের গন্ধ নিঃসৃত হয়। যার মাধ্যমে এরা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে এবং নিজেদের পরিভ্রমনের সীমানা চিহ্নিত করে রাখে। এই গন্ধ অনুসরণ করেই পুুরুষ এবং স্ত্রী বিনটুরং একত্রিত হয়।  

বিনটুরাং মূলত নিশাচর তবে দিন কিংবা রাত উভয় সময়ই এদের দৃষ্টি শক্তি ভালোভাবে কাজ করে। তাই দিন কিংবা রাত সবসময় এরা সক্রিয় থাকতে পারে। বিনটুরাং বিপদে পড়লে পানিতে লাফ দেয়। কারন এরা জন্মগত ভাবেই সাতারু। 

প্রজননকালীন আচরনঃ

আড়াই বছর বয়সে বিনটুরাং প্রজনন পরিপক্কতা অর্জন করে। বিনটুরাং এর প্রজননের কোন সুনিদির্ষ্ট সময় নেই। সারা বছর জুড়েই এরা মিলন করতে পারে তবে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য এরা অনুকূল পরিবেশের অপেক্ষা করে। অর্থাৎ এরা delayed implantation করতে পারে। ডিলেই ইমপ্লান্টেশন হচ্ছে মিলনের পর শুক্রানু এবং ডিম্বামু মিলিত হয়ে জাইগোট তৈরী করে। সেই জাইগোট বিকশিত না হয়ে জরায়ুর প্রাচীরে লেগে থাকে। মূলত অনুকূল পরিবেশে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য কিছু কিছু স্তন্যপায়ী প্রানী এমন বৈশিষ্ট অর্জন করেছে। যেমন- মেরু ভালুক। স্ত্রী প্রানীটি কয়েক মাসের মধ্যে অনুকূল পরিবেশ ও বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের সন্ধান ফেলে এবং খাদ্যের পর্যাপ্ত নিশ্চিয়তা পেলে সেই নিষিক্ত ডিম্বানু জরায়ুর প্রাচীর হতে বের করে ভ্রনের বিকাশ ঘটায়। অন্যথায় সেই নিষিক্ত ডিম্বানু বের করে দেয়। 

বিনটুরং এর গর্ভকালীন সময় তিন মাস। তিনমাস গর্ভধারনের পরে স্ত্রী বিনটুরং একটি বা দুইটি বাচ্চার জন্ম দেয়। জন্মের সময় বাচ্চাগুলো অন্ধ হয়ে জন্মায়। জন্মের প্রথম এক সপ্তাহ বাচ্চাগুলো মায়ের পশম আঁকড়ে ধরে ঝুলে থাকে। এক সপ্তাহ পরে বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটে। এইসময় এরা গাছের ডাল ধরে রাখার সক্ষমতা অর্জন করে। জন্মের পর থেকে আট থেকে দশ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চাগুলো মায়ের সাথে থাকে। এর পরে বাচ্চাগুলো স্বাধীনভাবে চলাচল করার উপযোগী হয়ে যায় এবং মায়ের সঙ্গ ছেয়ে স্বাধীনভাবে জীবন কাটানোর জন্য আলাদা হয়ে যায়। 

সামাজিক আচরনঃ

বিনটুরাং একাকী প্রানী। এরা দলবদ্ধভাবে না থেকে একা একা জীবন কাটাতেই পছন্দ করে।  তবে অনেক সময় মিলনের পর পুরুষ বিনটুরং স্ত্রী সাথে থেকে যায় বাচ্চা জন্ম নেওয়ার আগ পর্যন্ত। তবে বাবা হিসেবে পুরুষ বিনটুরং কোন দায়িত্ব নেয় না। আবার কখনো কখনো বাচ্চারা প্রজনেনর উপযুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত মায়ের সাথে থাকতে দেখা যায়। তাই বন্য পরিবেশে দুইটি বা তিনটির বেশী বিনটুরং একসাথে কখনো দেখা যায় ন।

আয়ুষ্কালঃ

বন্য পরিবেশে বিনটুরংগুলো ১৬ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তবে বন্দী অবস্থায় ২৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। 

এরা বিপন্ন প্রজাতিঃ

আবাসস্থল ধ্বংস, ঔষদ তৈরী, পশম সংগ্রহ ও পোষা প্রানী হিসেবে ব্যবহারের ফলে বন্য পরিবেশে এদের পরিমান হ্রাস পাচ্ছে। আবার কোন কোন অঞ্চলে এগুলোকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে যার ফলে এদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে অঞ্চলভেদে এরা ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে।  


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url