বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েলের পরিচিতি, বৈশিষ্ট, স্বাভাব, প্রজননকালীন আচরন ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব

The Oriental Magpie Robin
দোয়েল পাখি (Source Wikimedia Commons)

বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল আমাদের অতি পরিচিত একটি পাখি। সকালে দোয়েল পাখির মিষ্টি কণ্ঠে গান শুনে শুনে আমরা অভ্যস্ত। গ্রাম বাংলার সর্বত্রই দোয়েল পাখি বিরাজমান। সকাল সাঁজে দোয়েল পাখির মিষ্টি শিষ আমাদের মন মাতিয়ে তুলে। আসুন পরিচিত হই আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েলের সাথে।


দোয়েল পাখি পরিচিতিঃ

বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল এর ইংরেজি নাম Oriental Magpie Robin. দোয়েল পাখি প্রানি জগতে কর্ডাটা পর্বের Passeriformes বর্গের অর্ন্তগত একটি পাখি। দোয়েল পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Copsychus saularisফরাসী ভাষার Shama dayal এবং ওলন্দাজ ভাষায় Dayallijster এর সংমিশ্রিত রূপ দোয়েল।


দোয়েল পাখির ভৌগলিক এলাকাঃ

দোয়েল পাখির বিস্তার এশিয়া মহাদেশের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে। ভারত উপমহাদেশের বেশিরভাগ অংশেপাকিস্তানভারতবাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা থেকে পূর্ব দিকে দক্ষিণ চীন এবং দক্ষিণে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াথাইল্যান্ডমালয়েশিয়াসিঙ্গাপুরফিলিপাইনবোর্নিও এবং জাভা পর্যন্ত পাওয়া যায়। সম্প্রতি দোয়েল পাখির একটি জাত অস্ট্রেলিয়াতেও দেখা যায়।

দোয়েল পাখি জনবসতি কিংবা লোকালয়ের আশে পাশে থাকতে পছন্দ করে। এইকারনে এদেরকে কাঠসমৃদ্ধ বনচাষাবাদকৃত জমির আশেপাশে এবং গ্রামীন জনবসতি অঞ্চলে বেশী দেখা যায়। তবে গভীর বনে এদের খুব বেশী পাওয়া যায় না।

 

দোয়েল পাখির শাররীক গঠনঃ

দোয়েল আকারে ১৮-২১ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের এবং ৩১ থেকে ৮২ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। ডানা স্পষ্ট সাদা লম্বা দাগসহ কালচে বাদামি রঙের। ডানার দুই পাশে সাদা রঙের প্যাঁচ আছ যা উড়ার সময় দেখা যায়। ডানা বুজানো অবস্থায় কালচে দেখায়। লেজ কালো তবে প্রান্তঅংশ সাদা এবং লেজের তলায় বাদামি লালচে। এদের লম্বা লেজ বেশীরভাগ সময় পিঠের উপর খাড়া হয়ে থাকে। গলা-মাথা-বুক ও কপাল চকচকে কালো।  পায়ের উপরিভাগসহ পেট সাদা। চোখের পাশটা ঘন কালো। চোখের মণির রং পিঙ্গল। ঠোঁট কালো।

শাররীক গঠনে পুরষ, স্ত্রী ও বাচ্ছা দোয়েল পাখির মাঝে কিছু পার্থক্য আছে। পুরুষ দোয়েলের শরীরের উপরিভাগ ও গলার নিচে কালো রঙেরপেট সাদা। স্ত্রী-দোয়েলের উপরিভাগ ও গলার নিচ ছাই-রঙা হয়। পেটের অংশ পুরুষ-দোয়েলের মত উজ্জ্বল নয়বরং কিছুটা ফিকে সাদা।কিন্তু দেখতে অপরূপ সুন্দর।


দোয়েল পাখির বৈশিষ্ট ও স্বভাবঃ

দোয়েল পাখি গায়ক পাখি। বিভিন্ন রকম সুরে এরা গান গাইতে পারে। খাবারের চাহিদা না থাকলে এরা গাছের ডালে বসে মিষ্টি মোলায়েম শিস দে। লেজের ডগা নাচায়। স্থিরভাবে বসা অবস্থায় দোয়েলের লেজ মোরগের লেজের মতো দেখায়। দোয়েল পাখি অন্য পাখির ডাকও নকল করতে পারে।

এরা সাহসী, স্বাধীন এবং অস্থির ধরনের পাখি, সর্বদাই গাছের ডালে বা মাটিতে লাফিয়ে বেড়ায় খাবারের খোঁজে। এদের চাল-চলনে একধরনের আভিজাত্যের ছাপ দেখা যায় যার ফলে এরা খাবার সংগ্রহের সময় একেবারে লোকালয়ে চলে আসে যার ফলে বিড়াল কিংবা অন্য শিকারী দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হয়।

প্রজনন ঋতুতে পুরুষ দোয়েল খুব ভোরে এবং পড়ন্ত দুপুরে সুরেলা গলায় স্ত্রী দোয়েলকে আকৃষ্ট করার জন্য অত্যন্ত জোরে এবং সুরেলা গলায় গান গায়। তবে স্ত্রী দোয়েলও পুরুষ দোয়েলের উপস্থিতিতে ডাকতে পারে। সকালবেলা সূর্য উঠার আগেই দোয়েল গান গাওয়া শুরু করে দেয়। আর গানের মাঝে লেজ উঠেতে তাল মিলায়। দোয়েল এক নাগাড়ে সাত থেকে ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত গান গাইতে পারে।

প্রয়োজন না হলে দোয়েল এক নাগাড়ে বেশি দূর ড়ে না। মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে খাদ্য খোঁজে। ধান কিংবা ভাত খাবার জন্য এ পাখি গৃহস্থের গোলাঘরকিংবা রান্না ঘরেও ঢুকে পড়ে। উঠানবাড়িজুড়ে ওদের অবাধ চলাচল।

শীতের সময় দোয়েল পাখি দেখা যায় না বললেই চলে এর কারন হচ্ছে এরা শীতের সময় গান গায় না যার কারনে এই সময় এদের আমাদের নজরে পড়ে না।

দোয়েল পাখির মোলায়েম সুরের গানের জন্য অনেকেই এদেরকে খাচায় রাখতে পছন্দ করেন যদিও এরা খাচার জীবন পছন্দ করে না।

 

খাদ্যভাসঃ

দোয়েলের খাবার তালিকায় আছে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়কীটপতঙ্গকেঁচোখেজুরের রস এবং ফুলের মধু পান করবে। পঁচা ডাল পালা, গাছের পাতা সরিয়ে বিভিন্ন ধরনের ছোট পোকা মাকড়, মাকড়সা, ছোট ছোট শামুক ধরে খায় এরা। এমনকি টিকটিকিও খায়। সাধারনত সকালবেলা খাবারের খোজে বের হয় তবে মাঝে মাঝে  সন্ধ্যার আগে  এরা খাবারের খোঁজে বের হয়।


প্রজননকালীন আচরনঃ

দক্ষিণ এশিয়ার দোয়েলের প্রজননকাল মার্চ থেকে জুলাইআর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দোয়েলের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস। প্রজনন সম পুরুষ দোয়েলের শরীরের রঙ উজ্জ্বল ও চকচকে হ

প্রজনন শুরতে এরা জোড়া বেঁধে বাসা তৈরী করে। বাসা তৈরী করতে সাধারনত এক সপ্তাহ সময় লাগে। এরা মানুষের কাছাকাছি ছোট ছোট গাছ, ছাদের কার্ণিশে বাসা তৈরী করে। বাংলাদেশের যেসব পাখি বাসা বাঁধার গান গায় দোয়েল পাখি তাদের মধ্যে অন্যতম। গান গেয়ে আশপাশের সব পাখিকে বাসা বাঁধার খবর জানান দেয়

এ পাখির বাসা তৈরির উপকরণ যে কোনো গাছের অত্যন্ত সরু ডাল। মানুষের চুল। গবাদি পশুর পশম ও লোম। শুকনো দূর্বাঘাস। আরও আছে খড়উলুঘাসসাপের খোলসধানের শুকনো কুটোগাছের সরু-সরু শিকড়-বাকড়। পাট ও কলাগাছের শুকনো আঁশ।

গাছের ডালে বসে স্ত্রী দোয়েলকে আকৃষ্ট করার জন্য হরেকরকম সুরে ডাকাডাকি করে, স্ত্রী সঙ্গীর আশে পাশে এসে ডানা ঝাপটায়, পালক ফুলিয়ে লেজ তুলে স্ত্রী দোয়েলর আসে পাশে চলাচল করে। দোয়েল পাখি একসঙ্গে বা এক দিন বিরতি দিয়ে চার থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে। ডিমের রং ফিকে নীলচে-সবুজতার উপর বাদামী ছোপ থাকে।

স্ত্রী দোয়েল ডিমে তা দেয় এবং 10 থেকে ১৪ দিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হ। আর এইসময় পুরুষ দোয়েল পাহারাদারের কাজ করে। এসময় পুরুষ পাখিগুলো অনকে আক্রামণাত্বক হয়ে উঠে, বাসার আশেপাশে অন্য পাখিদের আসতে দেনা একই সাথে আশে পাশের এলাকাটা নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখার চেষ্টা করে। ডিম ফুটে বাচ্ছা বের হলে সাধারতন তিনদিন পর্যন্ত বাচ্ছাদের চোখ ফুটে না। এই সময় এরা একেবারেই নিরব থাকে। তিন থেকে চারদিন পর এর অল্প অল্প করে ডাকতে পারে এবং বাবা মাকে তাদের খিদের কথা জানান দেয়। বাচ্ছাকে খাওয়ানো দায়িত্ব বাবা মা দুইজনেই করে তবে মা দোয়েল বেশী সক্রিয় থাকে। ডিম ফুটে বাচ্ছা বের হওয়ার পর মোটামুটি 15 দিন পরেই বাচ্ছা দোয়েল উড়তে পারে এবং পরিপূর্ন স্বনির্ভর হতে সময় লাগে 15-20 দিন। এর পর বাবা দোয়েল তাদের  ঠুকরিয়ে বাসা থেকে বের করে দেয় স্বাধীন জীবন যাপন করার জন্য।


দোয়েল পাখির অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ

দোয়েল উপকারী পাখি। এরা আমাদের ফসলের এবং সবজি ক্ষেতের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে আামাদের ফসলকে রক্ষা করে। পাট বিনষ্টকারী বিচ্ছুকে খেয়ে পাটের গুনগত মান ঠিক রাখে। এছাড়া দোয়েল বাস্তুতন্ত্রের স্তিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে।

সাংস্কৃতিক মূল্যবোধঃ

বাংলাদেশের সাংস্কৃকিতে দোয়েল উজ্জ্বল হয়ে আছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিকদের লেখায় দোয়েল পাখির উপস্থিতি দেখা যায়। দোয়েল পাখির একটি ভার্ষ্কয ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আছে যার নামে উক্ত যায়গার নামকরন করা হয়েছে দোয়েল চত্বর। এছাড়াও বাংলার অনেক গানে দোয়েল পাখির শিষের কথাও উল্লেখ আছে।

 

দোয়েল পাখি সর্ম্পকিত প্রশ্নউত্তরঃ

০১. দোয়েল পাখি ইংরেজি কি?

উত্তরঃ দোয়েল পাখি ইংরেজি Magpie Robin

০২. দোয়েল পাখির বৈজ্ঞানিক নাম কি?

উত্তরঃ দোয়েল পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Copsychus saularis

০৩. দোয়েল পাখিকে জাতীয় পাখি বলা হয় কেনো?

উত্তরঃ দোয়েল বাংলাদেশের খুব পরিচিত পাখি যাকে বাংলাদেশের সর্বত্রেই দেখা যায়। কোন একটি প্রানীকে জাতীয় হিসেবে ঘোষনা করার পূর্বে অনেকগুলো বিষয় যাচাই করা হয় তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে তা কতোট পরিচিত এবং তা অন্য কোন দেশের জাতীয় প্রতিক কিনা।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতীয় পাখি হিসেবে ডাহুক, বক এবং শালিক পাখিকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে। তখণ তৎকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী জাকির হোসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রস্তাব করেন দোয়েল পাখিকে জাতীয় পাখি হিসেবে বিবেচনা করার জন্য। এর পিছনে যুক্তি ছিলো ডাহুক, শালিক কিংবা বক এইগুলো গ্রামীন পাখি যা সারা শহরু অঞ্চলে খুব কম দেখা যায়। পক্ষান্তরে দোয়েল পাখি সারা দেশের শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্রই দেখা যায়।

সেই প্রেক্ষিতে দোয়েল পাখিকে বাংলাদেশের জাতীয় পাখি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।


Post a Comment

How is this Article? Please say your opinion in comment box.

Previous Post Next Post