মেরু ভালুকের পশমের রং কি? মেরু ভালুক দেখতে সাদা কেনো?

সাদা রং এর মেরু ভালুক
মেরু ভালুক


মেরু ভালুক পৃথিবীর বৃহত্তম স্থলজ মাংসাশী প্রানী। আর্কটিক সমুদ্রের বরফ, নরওয়ে, রাশিয়া, গ্রিনল্যান্ড, আলাস্কা, কানাডার উপকূলে মেরু ভালুক বাস করে। তবে সমগ্র পৃথিবীর মেরু ভাল্লুকের ১৯টি উপ প্রজাতির দুই তৃতীয়াংশই বাস করে কানাডায়। সারা পৃথিবী জুড়ে মেরু ভালুকের সংখ্যা প্রায় ২৬০০০।

আর্কটিক তুন্দ্রায় বড় বৃক্ষ নেই। আর্কটিক তুন্দ্রার এই সমভূমিতে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে মেরু ভাল্লুক গুলোর পশমের রং বিবর্তিত হয়েছে। তুষারের সাথে এদের গায়ের পশমের রঙ্গের মিল থাকায় এরা সহজেই ছদ্মবেশে শিকারের একেবারে কাছে চলে আসতে পারে। আর্কটিক তুন্দ্রায় টিকে থাকার জন্য পশম মেরু ভাল্লুকের একটি প্রধান অস্ত্র। পশম ছাড়া একটি মেরু ভালুক দেখতে কালো রঙ্গের। কারন মেরু ভাল্লুকের চাড়মার রং কালো।

মেরু ভালুকের পশমের রং কি?

মেরু ভালুকের পশম তৈলাক্ত এবং পানিরোধী। শুধুমাত্র নাক এবং পায়ের তালু ব্যতীত সমগ্র শরীর পশম দ্বারা আবৃত। মেরু ভালুকের পশম পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ। এই স্বচ্ছ পশম আমাদের কাছে সাদা দেখায় তাই আমরা তাদের রং সাদাই দেখি। এই কারনে মেরু ভালুককে শুভ্র ভালুকও বলা হয়। এখন প্রশ্ন আসবে মেরু ভালুকের স্বচ্ছ পশম আমরা সাদা দেখি কেনো? এই আর্টিকেলের বাকি অংশ পড়লেই আপনি বুজতে পারবেন মেরু ভালুকের পশম আমরা সাদা দেখি কেনো?

মেরু ভালুক দেখতে সাদা কেন?

মূলত তিনটি কারনে মেরু ভালুকের স্বচ্ছ পশম আমাদের কাছে সাদা দেখায়। এই তিনটি কারন হচ্ছে

০১. মেরু ভালুকের পশমের গঠন।

০২. কেরাটিন নামক প্রোটিনের উপস্থিতি

০৩. মেরু ভালুকের ত্বকের কালো চমড়া

প্রাকৃতিক পরিবেশে এই তিনটি কারনে মেরু ভালুককে আমরা সাদা দেখি। তিনটি কারনের বিস্তারিত বিবররন- 

০১. মেরু ভালুকের পশমের গঠনঃ

মেরু ভালুকের কালো চাড়মার উপর পশমের দুটি স্তর থাকে। ভিতরের স্তরের নাম আন্ডার কোট যা পরু ও আকারে ছোট। বাহিরের স্তরের নাম গার্ড হেয়ার যা আকরে বড় হয়। গার্ড হেয়ার লম্বায় ৫-১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়।

গার্ড হেয়ারগুলো পরিষ্কার, স্বচ্ছ এবং মোটা। এগুলো বাতাসে পরিপূর্ণ একটি ফাঁপা নলের মতো। গার্ড হেয়ারে অনেকগুলো বাম্প থাকে। এই বাম্পগুলোকে বলা হয় আলো বিচ্ছুরনকারী কনা। মেরু ভালুক বেশীরভাগ সময় সমুদ্রের লোনা পানিতে থাকে। তাই প্রতিটি চুলের মধ্যে ছোট ছোট লবনের কণা লেগে থাকে। এই লবন কনাগুলোও আলো বিচ্ছুরনকারী কনা হিসেবে কাজ করে।

সূর্যের আলো যখন মেরু ভালুকের স্বচ্ছ গার্ড চুলে পড়ে তখন সাদা আলোক রশ্মির কিছু অংশ চুলের ফাঁপা অংশে আটকা পড়ে। এই আলোক রশ্মি চুলের ফাঁপা অংশে ক্রমাগত ভাউন্স করতে থাকে। ক্রমাগত ভাউন্সের ফলে চুলের ভিতর একধরনের শক্তি তৈরী হয় যা লুমিনেসেন্স নামক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফাঁপা চুলের ভিতর আলো ভাউন্স করার সাথে সাথে চুলের বাম্প বা আলো বিচ্ছুরনকারী কনাগুলোকেও আঘাত করে। এই আঘাতের ফলে আলো বিচ্ছুরনকারী কনাগুলো বিভিন্ন দিকে প্রেরিত হয়। এটি ক্রমাগত চলতে থাকে আলো বিচ্ছুরনকারী কনাগুলো একটি অপরটির সাথে মিলিত হয় এবং বাহিরের লবন কনাগুলোকেও আঘাত করে। চুলের অভ্যন্তরে এই সমস্ত ভাউন্সিং আলো চুলে সাদা আলো প্রতিফলিত করে। একই সাথে চুলের সাথে লেগে থাকা লবনের কনাগুলোও আলো বিচ্ছুরনকারী হিসেবে কাজ করে। ফলে সূর্যের আলোর উপস্থিতে মেরু ভালুককে সাদা দেখায়। 

সোজা কথায়, স্বচ্ছ গার্ড হেয়ারে আটকা পড়া সাদা আলোক রশ্মিগুলো লুমিনেসেন্স নামক প্রতিক্রিয়ায় বিচ্ছুরনকারী কনার সাহায্যে উজ্জ্বল সাদা রং বিচ্ছুরিত করে। যার ফলে আমরা মেরু ভালুককে সাদা দেখি।

০২. কেরাটিন নামক প্রোটিনের উপস্থিতি

মেরু ভালুকের গার্ড হেয়ার মূলত কেরাটিন নামক প্রাকৃতিক প্রোটিন দিয়ে তৈরী। কেরাটিন আমাদের চুলে, নখে এবং অন্যান্য প্রানীদের শিং ও খুরে পাওয়া যায়। এই প্রাকৃতিক কেরাটিন প্রোটিন অনুগুলোর মধ্যে একটি অফ হোয়াইট রং এর অনু থাকে। এই অফ-হোয়াইট প্রোটিন অনুর উপস্থিতির কারনে সূর্যের আলো মেরু ভালুকের উপর পড়লে পশমের রং সাদা দেখায়। 

০৩. মেরু ভালুকের ত্বকের কালো চমড়া

মেরু ভালুকের চাড়মার রং কালো। যেখানে গ্রিজলি ভালুক সহ অন্যান্য ভালুকের চাড়মার রং হয় গোলাপি। মেরু ভালুকের চাড়মার রং কালো কেনো হয়েছে তা নিয়ে নানা ধরনের মত আছে। অনেকেই মনে করেন সূযের তাপ বেশী ধরে রাখার জন্য মেরু ভালুকের চাড়মার রং কালো হয়েছে। কালো ত্বক সহজেই সূর্যের আলো শোষন করতে পারে যা ভালুককে উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে। যখন সূর্যের আলোর আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি ভালুকের কালো ত্বকে আঘাত করে তখন Fluorescence এর কারনে একটি সাদা রঙ্গ তৈরী হয়।

তাহলে মেরু ভালুকের আসল রং কি?

পোলার বিয়ারের রং স্বচ্ছ। সহজ কথায়, পোলার ভালুকের গার্ড চুল কর্তৃক আলো ধরে রাখা, গার্ড চুলের কেরাটিন নামক প্রোটিনে অফ হোয়াইট রং এর উপস্থিতি এবং মেরু ভালুকের কালো চাড়মা কর্তৃক আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মির কালো ত্বকে আঘাতের ফলে সাদা আলোক রশ্মি তৈরী হয়। যার ফলে মেরু ভালুকের রং সাদা দেখায়।

বিভিন্ন রঙ্গের মেরু ভালুক

সাদা রং এর মেরু ভালুকের সম্পর্কে এতোক্ষনে আমরা জেনে গেছি। তবে সাদা রং ছাড়াও হলুদ, ধূসর, কমলা এবং সবুজ রঙ্গের মেরু ভালুক দেখা যায়। সাদা ব্যাতীত এই ভিন্ন রং এর মেরু ভালুক পশমের রঙ্গের কারন কি? মেরু ভালুক বিভিন্ন রং-এ আসার কারন সমূহ নিচে দেওয়া হলো।

সবুজ রং মেরু ভালুক

চিড়ায়াখানার বদ্ধ খাচায় সবুজ রং এর মেরু ভালুক দেখা যায়। এছাড়াও মেরু অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশেও সবুজ রং এর মেরু ভালুক দেখা যেতে পারে। এই সবুজ রং এর মেরু ভালুক কিভাবে হলো?

মূলত সবুজ মেরু ভালুকের কোন রং না। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে মেরু ভালুকের পশম স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। চিড়িয়াখানার বদ্ধ খাঁচার পানিগুলোতে এবং ওয়ালে প্রচুর শেওলা জন্মায়। মেরু ভালুক মাঝে মাঝে খাঁচার ওয়ালের সাথে নিজেদের শরীর ঘর্ষণ করে। এই ঘর্ষনের ফলে এদের গার্ড হেয়ারে গর্ত তৈরী হয়। এ গর্ত দিয়ে শেওলা গার্ড হেয়ারের ফাঁফা অংশে প্রবেশ করে। মেরু ভালুকের দেহের উষ্ণ তাপমাত্রা এবং আদ্রতার কারনে শেওলাগুলো পশমের ভিতর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। যার ফলে বদ্ধ পরিবেশের মেরু ভালুক গুলোকে সবুজ দেখায়।

হলুদ রং মেরু ভালুক

মাঝে মাঝে কিছু হলুদ বর্ণের মেরু ভালুক দেখা যায়। মেরু ভালুকের রং হলুদ হয় মূলত তাদের খাদ্যভাসের কারনে। মেরু ভালুক যখন প্রচুর পরিমানে দাড়িওয়ালা এবং রিংযুক্ত সীল খায় তখন তাদের রং হলুদ দেখায়। এর কারন হচ্ছে দাড়িওয়ালা এবং রিংযুক্ত সীলে প্রচুর পরিমানে চর্বিযুক্ত তেল থাকে। এই চর্বিযুক্ত তেল প্রচুর পরিমানে খাওয়ার কারনে মেরু ভালুকের রং হলুদ দেখায়।

ধূসর রং মেরু ভালুক

সাধারতন মেঘলা দিনে মেরু ভালুকের রং সাদা পরিবর্তে ধূসর দেখায়। এর কারন হচ্ছে মেঘলা দিনে সূর্যের সাদা আলোক রশ্মির অনুপস্থিতি। এই সময় সূর্যের আলো গার্ড হেয়ারসমূহ খুব কম জমা হয়। যার ফলে আলো সমূহের বিকিরন খুব কম হয়। যার ফলে এই সময় সাদা মেরু ভালক সমূহকে ধূসর রং এর দেখায়। 

কমলা রং এর মেরু ভালুক

সাধারনত সূযাস্তের সময় মেরু ভালুককে কমলা কিংবা লাল রঙ্গের দেখায়। এর কারন গৌধূলির এই সময় সূর্য থেকে লাল বর্ণের আলোক রশ্মি নির্গত হয়। যা গার্ড হেয়ার কর্তৃক বিকিরিত হয়ে লাল/কমলা রঙ্গের দেখায়।

মেরু ভালুক কি রং পরিবর্তন করতে পারে?

মেরু ভালুক নিজে নিজে তার রং পরিবর্তন করতে পারে না। পরিবেশের উপর নির্ভর করে এদের রং এর বৈচিত্রতা দেখা যায়। বয়স বাড়ার সাথে পোলার বিয়ারের পশমের রং এ কিছুটা পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। যেসব অঞ্চলে তুষারের পরিমান কম সেইসব অঞ্চলের মেরু ভালুকগুলো দেখতে কিছুটা ধূসর বা হালকা বাদামী বর্ণের হয়। শুভ্র তুষারময় এলাকার মেরু ভালুকগুলো দেখতে একেবারেই সাদা।

পরিবেশের সাথে মিশে যাওয়ার জন্যও বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তাদের পশমের রং এ কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। এই পরিবর্তনটা হয় পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার জন্য এক অনন্য বৈশিষ্ট।

সাধারনত মে বা জুন মাসে মেরু ভাল্লুকের পশম সম্পূর্ণরূপে খসে পড়ে যায় এবং নতুন কর পশম গজায়। এই পশম খসে পড়া এবং নতুন করে গজানোর কাজটি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হয়। নতুন করে পশম গজানোর সময় তখন পশম কিছুটা হলুদাভ দেখা যায়।  

মেরু ভালুকের চামড়ার রং কি?

মেরু ভালুকের চাড়মার রং কালো। যেখানে গ্রিজলি ভালুক সহ অন্যান্য ভালুকের চাড়মার রং হয় গোলাপি। মেরু ভালুকের চাড়মার রং কালো কেনো হয়েছে তা নিয়ে নানা ধরনের মত আছে। অনেকেই মনে করেন সূযের তাপ বেশী ধরে রাখার জন্য মেরু ভালুকের চাড়মার রং কালো হয়েছে। কালো ত্বক সহজেই সূর্যের আলো শোষন করতে পারে যা ভালুককে উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে। মেরু অঞ্চলে টিকে থাকার জন্য কালো চাড়মা একটি বিবর্তনীয় পরিবর্তন। তবে মেরু ভালুকের শাবকগুলোর জন্মের পরে চাড়মার রং হয় গোলাপি যা তাদের পূর্ব পুরুষদের বৈশিষ্ট মনে করিয়ে দেয়। জন্মের পর হতে প্রায় পাঁচ মাস পর্যন্ত চাড়মার রং গোলাপী থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা ধীরে ধীরে কালো রং এর হয়ে যায়।

অন্ধকারে মেরু ভালুক দেখতে কেমন?

এতোক্ষনে আমরা জেনেছি সূর্যের আলোর কারনে মেরু ভালুকের রং সাদা দেখায়। তাহলে অন্ধকারে যখন সূর্যের আলো নেই তখন মেরু ভালুক দেখতে কেমন হবে?

এর উত্তর হচ্ছে অন্ধকারে মেরু ভালুককে দেখতে হলে আপনাকে তার উপর আলো ফেলতে হবে। আর আলো ফেলার কারনে মেরু ভালুক দেখতে সাদাই দেখাবে। তবে যদি অন্ধকারে ইনফ্রারেড ক্যামেরার সাহায্যে একটি মেরু ভালুক দেখা হয় তাহলে তা দেখতে কালো দেখাবে।

মেরু ভালুকের পশম স্বচ্ছ হলো কিভাবে?

মেরু ভালুকে পূর্ব পুরুষ ছিলো বাদামী ভালুক। বাদামী ভালুক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মেরু ভালুক তৈরী হয়েছে। আজ থেকে প্রায় দুই লক্ষ বছর আগে আর্টটিক মহাসাগর হিমায়িত হয়েছে। এই সময়ে বাদামী ভালুক খাবারের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়লে তাদের একটি দল মূল দল হতে আলাদা হয়ে উত্তারাঞ্চলে আটকা পড়ে। বিশাল আকৃতির বরফ এবং তুষার দুইটি দলকে আলাদা করে দিয়েছে।

উত্তরাঞ্চলের হিমশীতল বরফে আটকা পড়া এই বাদামী ভালুকগুলো টিকে থাকার জন্য লড়াই শুরু করে। টিকে থাকার লড়াইয়ে যারা কিছু বিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পেরেছে তারাই টিকে গেছে বাকিরা মারা গেছে। তুষারময় বরফের সমুদ্রে টিকে থাকার জন্য মেরু ভালুকের বেশ কিছু অভিযোজন ঘটেছে। যার মধ্যে রয়েছে পুরু পশম ও স্বচ্ছ ফাঁফা চুলের গঠন। এর স্বচ্ছ ফাঁফা চুল তুষারময় পরিবেশে নিজেদের আড়াল করে শিকার করতে সাহায্য করে। আবার সাতার কাটাতেও সাহায্য করে। একই সাথে শরীরে তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করে।

মন্তব্য

মেরু ভালুক প্রকৃতির এক অনিন্দ সুন্দর। বৈশ্বিক উষ্ণয়ানের ফলে মেরু ভালুক জীবন হুমকির মুখে। প্রকৃতির এই অনিন্দ্য সুন্দরকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। 

আরো পড়ুন মেরু ভালুকের আবাসস্থল, অভিযোজন, খাদ্যাভ্যাস, প্রজনন এবং শিকার

ইংরেজিতে পড়তে চাইলে- 

What color is apolar bear’s fur

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url