কাঠঠোকরা পাখির বাসস্থান, বৈশিষ্ট্য এবং খাদ্যাভাস

কাঠঠোকরা
কাঠঠোকরা পাখি
মাথায় রঙ্গিন পালক এবং লম্বাঠোটের একটি পাখি সারাদিন এই গাছ থেকে ঐগাছের গায়ে ছুটে বেড়ায় এবং লম্বাঠোট দ্বারা গাছের গায়ে আঘাত করে এমন দৃশ্য গ্রাম বাংলায় সচারচর দেখা যায়। রঙ্গিন এবং অপরূপ সৌন্দর্যের লম্বাঠোটের এই পাখিটিই আমাদের কাছে কাঠঠোকরা নামে পরিচিত। এই পাখিটি সারাদিন এক গাছ থেকে আরেক গাছে অনবরত আঘাত করে ঠকঠক শব্দ তৈরী করে। গ্রামে থাকেন অথচ কাঠঠোকরার ঠকঠক শব্দ শুনেন নাই এমন লোক খুজে পাওয়া যাবে না।

কাঠঠোকরা পাখির পরিচিতিঃ

কাঠঠোকরা
কাঠঠোকরা
কাঠঠোকরার ইংরেজী নাম Woodpecker এরা Picidae পরিবারের সদস্য। কাঠঠোকরার ইংরেজী নাম Woodpecker বৃক্ষবাসী এই  পাখিরা খুব কম সময়ই মাটিতে নামে এবং এরা একাকী থাকতে পছন্দ করে। অবশ্য কিছু কিছু প্রজাতির কাঠঠোকরা দলবদ্ধভাবে থাকতে পছন্দ করে। খুব বেশী প্রয়োজন না হলে এরা গাছ থেকে নামে না এবং লোকালয় এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। 

সারা পৃথিবীতে প্রায় ২০০ প্রজাতির কাঠঠোকরা খুজে পাওয়া গেছে যার মাঝ অধিকাংশই বর্তমানে বিলুপ্ত এবং প্রায় ২২ প্রজাতির কাঠঠোকরা বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশে ২২ প্রজাতির কাঠঠোকরা দেখা যায় যার মাঝে ২১টি স্থায়ী এবং ০১টি পরিযায়ী।

কাঠঠোকরা কোথায় পাওয়া যায়ঃ

পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই কাঠঠোকরা দেখা যায় তবে অস্ট্রেলিয়া, নিউ গিনি, নিউজিল্যান্ড, মাদাগাস্কায় এদের দেখা যায় না। এছাড়াও বৃক্ষহীন উত্তপ্ত মরুভূমিতে এবং পাথুরে এলাকায় এদের খুব বেশী দেখা যায় না। সচারচ তৃনভূমি, বৃক্ষবেষ্টিত অঞ্চলে এদের বেশী দেখা যায়।  

কাঠঠোকরা পাখির বৈশিষ্ট্যঃ

সবছেয়ে ছোট আকারের কাঠঠোকরা দৈর্ঘ্যে ৭.৫ সেন্টিমিটার এবং সবছেয়ে বড় প্রজাতির কাঠঠোকরা দৈর্ঘ্যে ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে বিলুপ্ত  Imperial প্রজাতির কাঠঠোকরারা ছিলো আকারে সবছেয়ে বড়। এরা দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫৫-৬১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ছিলো। ধারনা করা হয় এরাই সবছেয়ে বড় প্রজাতির কাঠঠোকরা। বর্তমানে জীবিত প্রজাতিগুলোর মধ্যে Great Slaty কাঠঠোকরাগুলো আকারে সবছেয়ে বড়। এরা দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪৫-৫৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং এদের ওজন প্রায় ৪৩০ গ্রাম থেকে ৫৬৩ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।

কাঠঠোকরার পালকের রং প্রজাতিভেদে ভিন্ন হয়। অনেক প্রজাতির রং কালো বা কালো সাদার প্যাটার্নের সমন্বয়, কোন প্রজাতির রং জলপাই রঙ্গের। তবে বেশীর ভাগ প্রজাতিতেই দুইতিনটা রঙ্গের প্যাটার্ন দেখা যায়। অনেক প্রাজাতির গায়ে সাদার উপর কালো বা বাদামী চোপচোপ দাগ থাকে যা তাদের ছদ্মবেশ ধরতে সাহায্য করে। অনেক প্রজাতির মাথায় একটি রঙ্গিন মুকুট থাকে কারো ক্ষেত্রে রঙ্গিন পালক থাকে।

গাছের কান্ডে আঁকড়ে ধরার সুবিধার জন্য কাঠঠোকরার পায়ের নখের বিন্যাস বিশেষ ভাবে সুগঠিত যার ফলে এরা গাছের কান্ড আঁকড়ে ধরতে এদের কোন অসুবিধা হয় না। ঠোটের মতো এদের পা এবং নখও শক্তিশালী। যারফলে এরা খাড়া গাছের গায়েও স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারে। 

সকল কাঠঠোকরার পায়ে চারটি আঙ্গুল থাকলেও কালো-পিঠযুক্ত কাঠঠোকরা এবং আমেরিকান ও ইউরেশীয় কাঠঠোকরার পায়ে তিনটি করে আঙ্গুল থাকে।

কাঠঠোকরা কি খায়ঃ

কাঠঠোকারার প্রধান খাবার হচ্ছে পোকামাকড়, লার্ভা, নিম্প, পিপড়া এবং পিপড়ার ডিম। এরা গাছের গায়ে লেগে থাকা কিংবা মৃত গাছের বাকলের নিছে থাকা বিভিন্ন পোকামাকড় খেয়ে থাকে। এছাড়াও গাছের গায়ে বাস করা বিভিন্ন পোকার লার্ভাা এবং পিঁপড়া ও পিঁপড়ার ডিম খেয়ে থাকে। বেশীরভাগ সময় দেখা যায় কাঠঠোকরা মৃত গাছের গায়ে গর্ত করছে। এর কারন হচ্ছে গাছ  মারা যাওয়ার পরে এতে বিভিন্ন রকম পোকামাকড় আবাস গড়ে তোলে। বিশেষ করে উঁইপোকা, কাঠ পচনকারী ঘুন বা উলু পোকা গাছের গায়ের বাকলের নিছে বাসা করে। কাঠঠোকরা ঠোটদ্বার গাছের গায়ে আঘাত করে পঁচা বাকল ফেলে সেইসব পোকা খায়। এছাড়া মাঝে মাঝে এরা মাটিতে পড়ে থাকা মৃত গাছ ও আবর্জনা হতে পোকা সংগ্রহক করে খায়।  

কাঠঠোকারার মজার কিছু বৈশিষ্ট্যঃ

০১.    কাঠঠোকরার জিহ্বা তাদের ঠোটের ছেয়েও বড়ঃ

কাঠঠোকরার কথা শুনলে আমাদের মনে যে ছবি আসে আসে লম্বা ঠোটের একটি পাখি। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন যে কাঠঠোকরার ঠোটের ছেয়েও তাদের জিহ্বা অনেক বড়।

মানুষ সহ অধিকাংশ মেরুদন্ডী প্রানীদের গলায় ইউ আকৃতির হায়য়েড (hyoid) নামক একটি হাঁড় থাকে যেখান জিহ্বার গোড়া সংযুক্ত থাকে। কাঠঠোকরার ক্ষেত্রে এই হায়য়েড (hyoid) হাঁড়টির অবস্থান উপরের চঞ্চুতে অবস্থিত নাসারন্ধের মধ্যে। হায়য়েড (hyoid) হাঁড় থেকে শুরু হয়ে চক্ষু অঞ্চলে এসে এটি দুটি ভাগে ভাগ হয়ে ভি আকৃতি নিয়ে মাথার খুলির চারপাশ সম্পূর্ণ আবৃত করে নিচের চঞ্চুতে এসে আবার মিলিত হয়। যার ফলে এদের জিহ্বার দৈর্ঘ এদের ঠোটের তুলনায় অনেক বড় হয়।  হায়য়েড হাঁড়ের সংকোচনের ফলে এই জিহ্বা সংকোচিত হয়ে মাথার পিছনের খুলির মধ্যে লুকিয়ে যায় আবার প্রসারনের ফলে বের হয়ে আসে।

কাঠঠোকরার জিহ্বা হয় আঠালো ধরনের যার ফলে গর্তের ভিতরে কোন পোকামাকড় পেলে তারা জিহ্বার আঠা দ্বারা সেই পোকাকে আটকে মুখে নিয়ে আসে। সম্প্রতি গবেষনায় জানা যায়  কাঠঠোকরা তার লম্বা জিহ্বা দিয়ে শিকার টেনে আনার আগে শিকারকে লম্বা জিহ্বা দ্বারা ঘিরে ফেলে তারপর টেনে মুখে নিয়ে আনে। 

কাঠঠোকরার জিভ কত লম্বা?

কাঠঠোকারার জিহ্বার দৈর্ঘ্য তাদের শরীরের দৈর্ঘ্যের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত হতে পারে। তবে সব কাঠঠোকরার জিহ্বার দৈর্ঘ্য সমান বড় হয় না। প্রজাতি ভেদে জিভের দৈর্ঘ্য কম বেশী হয়। Green woodpecker নামক কাঠঠোকরার জিহ্বার দৈর্ঘ্য অন্যসব কাঠঠোকরার ছেয়ে বড়। তবে উত্তর আমেরিকার নর্দান ফ্লিকার (Northern Flicker) তার লম্বা জিহ্বার জন্য বিশ্ব রেকর্ড করেছে।

কাঠঠোকরারা লম্বা জিহ্বার কাজ কি?

মূলত গর্তথেকে পোকামাকড় বের করে আনার জন্যই তাদের এতো লম্বা জিহ্বার প্রয়োজন হয়। কিন্তু পাখিজগতে আরো অনেক পাখিই তো পোকামাকড় খায় তাহলে তাদের জিহ্বাতো এতো লম্বা হয় না, কাঠঠোকরার কেনো?

এর উত্তর হচ্ছে মূলত শিকার ধরার না বরং তাদের ছোট মস্তিষ্ককে রক্ষা করার জন্যই তাদের জিহ্বার এমন বিবর্তন। এদের জিহ্বাগুলো মস্তিষ্কের পিছনে আবৃত করে থাকে। যারফলে এরা যখন ঠোট দ্বারা খুব জোরে গাছের গায়ে আঘাত করে তখন সমান বেগে আঘাত তাদের মাথায় লাগে। এই আঘাত থেকে তাদের মস্তিষ্ককে সুরক্ষা করার জন্যই তাদের ঠোটের এমন বিবর্তন। অবশ্য শুধুমাত্র জিহ্বাই যে মস্তিষ্ককে আঘাত থেকে রক্ষা করে ব্যাপারটা এমন না এর সাথে মস্তিষ্কের হাঁড়েরও ভূমিকা রয়েছে।

কাঠঠোকরা পাখি
কাঠঠোকরা

২. কাঠঠোকরার নাক ফিল্টারের কাজ করেঃ

কাঠঠোকরার অস্পষ্ট নাক রয়েছে। এই নাকের চিদ্রগুলো পালকে আবৃত থাকে। এরা যখন গাছের গায়ে খোঁচায় তখন নাকের এই চিদ্রগুলো ফিল্টারের মতো ধুলোগুলো বের করে দেয় যারফলে কাঠের গুড়ো এবং বালি এদের পাকস্থলিতে যেতে পারে না।

০৩. কাঠঠোকরা অনবরত ঠোকরাতে পারেঃ

কাঠঠোকরার মস্তিষ্কের হাঁড়ের গঠন এমনভাবে তৈরী যে এরা অনবরত গাছের গায়ে আঘাত করার পরেও বিপরীতমুখি আঘাতে এদের মস্তিষ্কের কোন ক্ষতি হয় না। যারফলে এরা গাছের গায়ে অবরবত আঘাত করতে পারে। এরা দিনে ১২০০০ বার তাদের ঠোট দিয়ে আঘাত করতে পারে। আর এমন আঘাতের পরেও তাদের মস্তিষ্কে এর কোন প্রভাব পড়ে না।

৪. কাঠঠোকরা সুন্দর পছন্দ করেঃ

কাঠঠোকরা দেখতে অনেক সুন্দর। এদের বাহরী রং যে কারোই নজর কাড়তে যথেষ্ট। আপনি জানেন কি কাঠঠোকরা নিজেদের পছন্দ মতো বাসা বানায়। এরা বিভিন্ন গাছের গায়ে কিংবা একই গাছে অনেক গর্ত করে কিন্তু সব গর্তে তারা বাসা বানায় না। কারন বাসার নিরাপত্তা, আকার আকৃতি তাদের পছন্দ না হলে তারা সেই গর্তে বাসা বানায় না। আবার একই গর্তে একবারের বেশী বাসা বানায় না। অর্থ্যাৎ এরা প্রতি বছর বাসা পরিবর্তন করে। আর তাদের পরিত্যাক্ত গর্তেই টিয়া, শালিক সহ অন্যপাখিরা বাসা বানায়।  

৫. কাঠঠোকরা গান করতে পছন্দ করেঃ

কাঠঠোকরা গায়ক পাখি না তাই তারা তাদের গলা দ্বারা কোন গান করতে পারে না। প্রানীজগতে একমাত্র কাঠঠোকরাই একমাত্র প্রানী যারা তাদের গলা দ্বারা কোন শব্দ উচ্চারন না করে ঠোট দ্বারা শব্দ উচ্চারন করে। আমরা সবসময় যা দেখি কাঠঠোকরা গাছের গায়ে আঘাতের ফলেই শব্দ হয় এবং ভাবি এরা তা করে শুধুমাত্র গর্ত করার জন্য। ব্যাপারটা আসলে তা নয়। এরা শুধু গর্ত তৈরী করার জন্য গাছের গায়ে আঘাত করে না বরং শব্দ তৈরীর জন্য আঘাত করে। এই শব্দটা তারা বিভিন্ন উদ্দেশ্য করে থাকে। তবে মূল উদ্দেশ্য হচেছ যোগাযোগ করা।  আমরা ভালো লাগলে যেমন গান গাই, অন্যপাখিরা শিস দেয় কিংবা ডাকাডাকি করে, যোগাযোগ করার জন্য ভাষার ব্যবহার করি এবং অন্যপ্রানীরা শব্দ তৈরী করে। বেচারা কাঠঠোকরা তা পারে না কিন্তু তাই বলে কি তারা যোগাযোগ করবে না? আনন্দ প্রকাশ করবে না?

হ্যা তারা আনন্দ প্রকাশ করার জন্য, যোগাযোগ করার জন্য গাছের গায়ে আঘাত করে শব্দ তৈরী করে।  

তারা এলাকায় যোগাযোগ করতে, সঙ্গীদের আকৃষ্ট করতে, খাবারের সন্ধান করতে বা এমনকি ব্যায়াম বা খেলার জন্যও এরা বিভিন্ন বস্তুর উপর আঘাত করে।

৬. কাঠঠোকরা সোজা থাকতে পছন্দ করেঃ

কাঠঠোকরা খুব বেশী প্রয়োজন না হলে গাছের ডালে বসে থাকে না বরং গাছের গায়ে সোজা হয়ে থাকে। গাছের গায়ে সোজা হয়ে থাকার জন্য এদের লেজ হালের মতো কাজ করে। একই সাথে এদের পায়ের নখও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এদের এই বৈশিষ্ট্যের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেদের সত্বন্ত্রতা বজায় রাখা। পোকামাকড় খাওয়া পাখির সংখ্যাই বেশী বর্তমানে। তাই খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা বেশী। আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এরা এই সত্বন্ত্র বৈশিষ্ট্যটা ব্যবহার করে। যার ফলে গাছের গায়ে লেগে থাকা লার্ভা, পোকামাকড় কিংবা পিপড়া এরা সহজেই শিকার করতে পারে।

৭. কাঠঠোকরারা বাদাম পছন্দ করেঃ

এতোক্ষন পড়ার পরে আপনি ধরে নিয়েছেন কাঠঠোকরা শুধুমাত্র পোকামাকড়ই খায়। বাস্তবে তা নয়। কাঠঠোকরা বাদাম এবং বেরীফলও পছন্দ করে। যারকারনে এদেরকে বাদাম কিংবা বেরী বাগানেও দেখতে পাওয়া যায়।

০৮. কাঠঠোকরা মৃত গাছ পছন্দ করে

কাঠঠোকরার ঠোটের গঠন ও শক্তি যেকোন শক্তগাছে গর্ত করতে সক্ষম কিন্তু তারপরেও তারা মৃত গাছ বেশী পছন্দ করে। এর কারন হচ্ছে মৃতগাছের কাঠ কিছুটা নরম থাকে যারফলে গর্ত করতে তাদের জন্য সহজ হয়। আবার এইসব গাছে গর্ত করলে কাঠ পচনকারী বিভিন্ন পোকার লার্ভা পাওয়া যায়। তাই কম পরিশ্রমে বেশী খাবার পাওয়ার জন্যই তারা মৃত গাছকে বেশী পছন্দ করে।  

কাঠঠোকারা সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্যঃ

 ০১. কাঠঠোকরার দলকে DESCENT বলা হয়

পাখিরা স্বজাতীদের সাথে দলবেঁধে থাকতে পছন্দ করে। যেমন- টিয়াপাখির ঝাঁক, চুড়ই পাখির ঝাঁক, কবুতরের ঝাঁক ইত্যাদি। পাখিদের এই ঝাঁকের একটা সত্বন্ত্র নাম থাকে। যেমন কাকের ঝাঁক বা দলকে এক কথায়  murder বলা হয়। আবার বাজপাখির ঝাঁক বা পালকে  kettle বলা হয়।  তেমনি একদল কাঠঠোকরার দল বা ঝাঁককে  "descent" বলা হয়। 

 ০২. সামাজিক কাঠঠোকরাঃ

কাঠঠোকরা একাকী থাকতে পছন্দ করে এবং বেশীর ভাগ সময় একটি বা দুইটি কাঠঠোকরা একসাথে দেখা যায়। কিন্তু Acorn Woodpecker অন্য সব কাঠঠোকরা হতে আলাদা। Acorn Woodpecker রা নিজেদের মধ্যে এবং অন্য কাঠঠোকরাদের সাথে সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো রয়েছে। এই ধরনের কাঠঠোকরারা একাকী না থেকে দলবদ্ধ ভাবে ১০-১৬টি পাখি একসাথে থাকে। পারিস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এরা গাছের গায়ে গর্ত করবে এবং বংশবৃদ্ধি করবে। আবার দলবদ্ধভাবে এরা খাবার সংগ্রহ করে তা গাছের গায়ের গর্তে লুকিয়ে রাখে ভবিষ্যতের সঞ্চয় হিসেবে। আবার একে অপরের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সঞ্চিত খাদ্যের নিরাপত্তা রক্ষা করে্ এবং কোন আক্রমন হলে দলবদ্ধভাবে সবাই তা প্রতিহত করে।

০৩. কাঠঠোকরা রাতে শব্দ করে নাঃ

কাঠঠোকরা দিনে সক্রিয় থাকে এবং রাতে বাসায় বিশ্রাম নেই। তাই এরা রাতের বেলায় গাছের গায়ে গর্ত করে না বা কোন শব্দ করে না। আবার দিনের আলো ভালো করে না ফুটলে এরা বাসা থেকে বের হয় না। তাই কাঠঠোকরার ঠোকরানোর শব্দ আপনি শুধুমাত্র দিনের বেলাই শুনতে পাবেন। রাতে বা সকালে না। 

০৪. কিছু কাঠঠোকরা  ক্যাকটাসে বাস করেঃ

হ্যা ঠিকই শুনেছেন। কাঠঠোকরা শুধুমাত্র গাছের গায়ে গর্ত করে বাসা বানাবে এমন না তারা সুযোগ পেলে ক্যাকটাসের গায়েও বাসা বানাতে পারে। Gila Woodpeckers নামের কাঠঠোকরা প্রজাতিটি Sonoran Desert, Nevada, and Arizona দেখতে পাওয়া যায়। মরুভূমির জীবনের সাথে এরা খাপ খাইয়ে নিয়েছে। মরূভূমির উদ্ভিদ giant saguaros নামক ক্যাকটাসগুলো আকারে প্রায় পঞ্চাশ ফুট পর্যন্ত হতে পারে এবং এগুলো প্রায় ২০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। বাসা বানানোর জন্য Gila Woodpeckers গুলো এই গাছটাকেই পছন্দ করে। শুধুমাত্র নরম বলে না বরং এই গাছে যে ফল হয় তাও এই কাঠঠোকরাগুলো খায়। 

০৫.সবছেয়ে বড় কাঠঠোকরাঃ

কাঠঠোকরা প্রজাতির মধ্যে আকারে সবছেয়ে্ বড় জাত হলো Ivory-billed Woodpecker যা বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধারনা করা হয়। বর্তমানে পাওয়া যায় এমন প্রজাতির মধ্যে PILEATED WOODPECKERS সবছেয়ে বড় জাতের কাঠঠোকরা। এগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬-১৯ ইঞ্চি। দেখতে প্রায় কাকের আকারের সমতুল্য।

০৬. কাঠঠোকরা কাঠ খায় নাঃ

কাঠঠোকরা সারাদিন গাছের গায়ে গর্ত করলেও তারা কিন্তু কাঠ বা গাছের কোন অংশ খায় না। যদিও অনেক লোক মনে করতে পারে যে কাঠঠোকরা কাঠ খায়, যেমন বিভার কাঠ খায়, তারা আসলে তা করে না। কাঠঠোকরা কাঠের মধ্যে গর্ত খনন করার জন্য তাদের ঠোঁটগুলিকে একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে যা তাদের বাসা বাঁধার গর্ত খনন করতে বা গর্ত থেকে পোকামাকড় এবং পোকামাকড়ের লার্ভা পেতে দেয়।

০৭. কিছু ধরণের কাঠঠোকরা বাচ্চা পাখি খায়ঃ

কাঠঠোকরা প্রজাতির মধ্যে Great Spotted Woodpecker এই প্রজাতির কাঠঠোকরাগুলো সর্বভূক ধরনের হয়। এরা পোকামাকড়ের সাথে অন্য পাখির বাচ্চা, ডিম চুরি করে খায়। যদিও বেশীর ভাগ কাঠঠোকরাই শান্ত স্বাভাবের হয়ে থাকে। খাবারের সংকট কিংবা আত্বরক্ষার জন্য এরা অন্যপ্রানী এবং তাদের বাসায় আক্রমন করে।

কাঠঠোকরা পাখি কাঠ ঠোকরায় কেনো?

আমারা প্রায় সময়ই দেখি কাঠঠোকরা পাকি গাছ বসে গাছটাকে ঠোকরিয়ে ঠোকরিয়ে গর্ত করে ফেলছে। আমরা অনেকেই ধারনা করি তারা গাছে গর্ত করে বাসা করার জন্য। কাঠ ঠোকরা শুধু বাসা বানানোর জন্য গাছে গর্ত করে না বরং আরো নানা কারনে তারা গাছে গর্ত করে। কাঠঠোকরা পাখি কেনো গাছে গর্ত করে তার কয়েকটি কারন নিছে দেওয়া হলো-

০১. খাদ্য খোজার জন্যঃ

কাঠঠোকরা ডাইনোপিয়াম গনের পাখি। এই গনের সব পাখিই মূলত পোকামাকড় শিকার করে খায়। কখনো খেয়াল করে দেখবেন কাঠঠোকরা দুই পা দিয়ে গাছের একপাশ থেকে আরেকপাশে দ্রুত হেঁঠে বেড়ায়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে গাছের গায়ের বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়, পিঁপড়া এবং লার্ভা খোজা। আমরা জানি মৃত গাছে কাঠের বিভিন্ন পোকামাকড় গাছের ভিতরে থেকে কাঠকে ক্ষয় করে ফেলে। কাঠঠোকরা এইসব পোকামাকড় ধরার জন্য তাদের লম্বা ঠোট দ্বারা গাছের গায়ে গর্ত করে। যদিও এরা ঠোট দ্বারা গাছে গর্ত করে কিন্তু পোকামাকড় ধরার জন্য এদের রয়েছে লম্বা জিহ্বা। এরা গাছের গায়ে কোন পোকামাকড় পেলেই তা লম্বা জিহ্বাদ্বারা ধরে খেয়ে ফেলে।

 ০২. যোগাযোগের জন্যঃ

কাঠঠোকরা শ্রমিক পাখি গায়ক পাখি না। যার ফলে এরা জোরে জোরে ডাকতে পারে না। পাখিদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে তাদের গলার স্বর বা ডাকাডাকি। কাঠঠোকরা ডাকতে পারে না তাই তারা যোগাযোগ করার জন্য গাছের গায়ে জোরে জোরে আঘাত করে শব্দ তৈরী করে। আর এই শব্দ দ্বারাই তারা তাদের সঙ্গীর সাথে যোগাযোগ করে। 

০৩. নিজের উপস্থিতি এবং এলাকা নির্ধারন করাঃ

কাঠঠোকারা গাছের গায়ে তাদের লম্বা ঠোট দ্বারা আঘাত করে জোরে জোরে শব্দ করে আশে পাশের সবাইকে তার নিজের উপস্থিতি জানান দেয় একই সাথে নিজের বিচরন এলাকায় অন্য কোন কাঠঠোকরার প্রবেশ বন্ধ করতে তারা জোরে জোরে শব্দ করার জন্য গাছের গাছের গায়ে আঘাত করে। 

০৪. শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্যঃ

প্রতিটি প্রনীই ভয় পেলে চিৎকার করে এবং যতো দুর্বলই হোক না কেনো যখন আক্রমন তীব্র হয় তখনি শত্রুর উপর চড়াও হয়। কাঠঠোকরাও তেমনি কোন শত্রুর উপস্থিতি টের পেলে গাছের গায়ে ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে জোরে শব্দ করে শত্রুকে ভয় দেখায়। একই সাথে নিজের নিরাপত্তা রক্ষা করে।

০৫. বাসা তৈরীর জন্যঃ

দিন শেষে প্রতিটা প্রানীই নিজ নিড়ে ফিরে আসে। সব প্রানীই নিজের সর্বোচ্ছ দিয়ে চেষ্টা করে তাদের বাসার নিরাপত্তা রক্ষা করতে।  কাঠঠোকরার নিজের নিড় বানানোর জন্য সবছেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে খাদ্যের জন্য গাছের গায়ে যে গর্তগুলো করেছে তা। কারন এতে তাদের বাসার নিরাপত্তা ঠিক থাকে আর চাইলেও কেউ সহজে তাদের বাসায় আক্রমন করতে পারে না। 

মন্তব্যঃ 

প্রানীজগতে প্রতিটি প্রানীই গুরুত্বপূর্ণ। কাঠঠোকরা অনেকটা নিরীহ একটি পাখি কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কাঠঠোকরার বাসস্থান সংকট  তৈরী হচ্ছে যার ফলে প্রকৃতির অপরূপ সুন্দর এই পাখিটি দিনকে দিনে কমে যাচ্ছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে বন্যপ্রানীদের সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url